লায়লাতুল মে’রাজ ২৭শে রজব নয় (?)

লায়লাতুল মে’রাজ ২৭শে রজব নয় (?)
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
আল্লাহতায়া’লা যখন আমাদের নবী করীম (সাঃ) কে পৃথিবীতে সমস্ত কামালাত দান করার পরে তাঁর বন্ধুকে আসমানেরও কামালাত দান করার ইচ্ছা করলেন। কাজেই হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে “রেসালাত” এর মাকাম থেকে উন্নিত করে “উবুদিয়াত” মাকামে পৌঁছালেন। কারণ, উবুদিয়াত এর মাকাম রিসালাতের মাকামের উর্দ্ধে। উবুদিয়াত হলো- “খলক” বা সৃষ্টিকূলকে পরিত্যাগ করে হক বা স্রষ্ট্রার প্রতি মনোযোগী হওয়া।” আর ইহাকেই “মাকামাতে জমা’ বা সম্মিলনের মাকাম বলা হয়। অন্যদিকে রেসালাত হলো- “হক” বা স্রষ্ট্রাকে ছেড়ে সৃষ্টির প্রতি মনোযোগী” হওয়া। ইহাকেই মাকামাতে ফরক” বলে। (তাফসীরে রুহুল বায়ান ৫ম খণ্ড; ১০৩ পৃষ্টা) আরবী।
মেরাজের রাতে হজরত জিব্রাইল ও মিকাইল (আঃ) এসেছিলেন। জিব্রাইল (আঃ) কোন প্রকার অস্ত্র ছাড়াই অস্ত্রোপাচার করেন এবং মিকাইল (আঃ) কে জমজমের পানির একটি তাস্ত দিতে বলেন এবং তিনবার ধৌত করে বাছারিয়াত বা মানবীয় গুণ বের করে ইমান ও হিকামত দ্বারা কলবকে পরিপূর্ণ করে স্ব-স্থানে পুনরায় রেখে দেন। (আল ফাতহ; ইবনে হাজার; ২য় খণ্ড ৫৮৯ পৃষ্ঠা)
আলাউদ্দীন মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান আল-বুখারী তাঁর তাফসীরের মধ্যে লিখেছেন যে, মে’রাজের রাতে রাসূল (সাঃ) পাঁচ প্রকারের বাহন ব্যবহার করেছিলেন। যেমন, (১) বোরাক- মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকছা পর্যন্ত। (২) মেরাজ- বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে প্রথম আসমান পর্যন্ত। (৩) আজনেহাতুল মালায়েকা বা ফেরেস্তাদের ডানা- প্রথম আসমান হতে সপ্তম আসমান পর্যন্ত। (৪) জানাহু জিব্রাইল বা জিব্রাইলের ডানা- সপ্তম আকাশ হতে সিদরাতুল মুন্তাহা। (৫) রফরফ- সিদরাতুল মুন্তাহা থেকে কা’বা কাউসাইন। (কাশফুজ জুনুন; ১ম খণ্ড ৪৫৪ পৃষ্ঠা)
ছহী মতানুসারে, হিজরতের দু বছর পূর্বে মে’রাজ হয়েছিল, যখন আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) এর বয়স মোবারক ৫১ বছর, ৯ মাস ২৮ দিন ছিল। [রওজা; ইমাম নববী (রহঃ)]
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো- তাফসীরে রুহুল মা’য়ানীতে আল্লামা আলুসী বাগদাদী (রহঃ) যতগুলো মাসের কথা উল্লেখ করেছেন তাতে “রজব” মাসের উল্লেখ নাই এবং ২৭ তারিখের কথাও নাই। অথচ সাধারণ মানুষের মধ্যে ২৭শে রজব প্রচলন করে দেয়া হয়েছে। তবে, ইবনুল আসির “আল-কামিল” নামক গ্রন্থে এবং জামালুদ্দীন আবুল মাহাসিন আত্-তাবাকী “আন নুজুমুজ জাহেরা ফি তারিখে মিছর ওয়াল কাহেরা” নামক গ্রন্থে লিখেছেন-
“সুলতান সালাহ উদ্দীন ইউসুফ ইবনে আউয়ুবী যখন বায়তুল মুকাদ্দাস জয়লাভ করেন এবং সেখানে প্রবেশ করেন সেইদিন ২৭শে রজব ছিল। ফলে, ইসলামী বিশ্ব এই ব্যাপারে আনন্দোৎসব করে যে, এটাই তো “মেরাজ” এর রাত।” এ ঘটনাটি ২৭টি বৃহৎ গ্রন্থে লিখা হয়েছে।
সাধারণ এবং বিশেষ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সাধারণভাবে প্রচলিত হয়ে গেছে যে, আমাদের পয়গম্বর (সাঃ) এর মে’রাজ ২৭শে রজব সংঘটিত হয়েছিল। যাইহোক, এই বিশেষ রাতে আমাদের পয়গম্বর (সাঃ) এর ৩টি সফর হয়েছিল। যেমন-
১. মসজিদে হারাম তথা “কা’বা” শরীফ থেকে “বায়তুল মুকাদ্দাস” পর্যন্ত এবং এই সফরকে বলা হয়- “ইসরা”। এসরা নচ্ছে কেতঈ দ্বারা প্রমাণিত। যেমন-
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
(সূরা বানি ইসরাইল; ১)
মসজিদে আকসা পৃথিবী দ্বিতীয় নির্মিত মসজিদ এই মসজিদে দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না। যেমন, ইমাম আহমদ (রহঃ) তাঁর মসনদে হাদিছ উল্লেখ করেছেন যে, “দাজ্জাল সমস্ত পৃথিবী পরিভ্রমন করবে; কিন্তু ৪টি মসজিদ ছাড়া- মদিনার মসজিদ, মসজিদে মক্কা, মসজিদে আকসা এবং মসজিদে তুর (সেনান পর্বতে অবস্থিত)। (মসনাদে আহমদ; হাদিছ নম্বর-২৩০৯০) আর “আকায়েক” নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, “রাসূল (সাঃ) মসজিদে আকসাতে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন; প্রথম রাকাতে সূরা কাফেরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা এখলাছ তেলাওয়াত করেছিলেন।”
আরোও উল্লেখ্য যে, উক্ত নামাজের জামাতে পয়গম্বরগণের ৭ কাতার ছিল, তন্মধ্যে ৩ কাতার রসূলগণের ছিল।
২. “বায়তুল মুকাদ্দাস” থেকে সপ্তম আসমান পর্যন্ত; এই সফরকে বলা হয় “মে’রাজ”। যেমন-
وَ لَقَدۡ رَاٰهُ نَزۡلَۃً اُخۡرٰی عِنۡدَ سِدۡرَۃِ الۡمُنۡتَهٰی
(সূরা নজম; ৫২-৫৩)
এছাড়া হাদিছে বলা হয়েছে-
ছুম্মা জাহাবা বি ইলা সিদরাতিল মুন্তাহা
(বোখারী; ১ম খণ্ড ৫৪৯ পৃষ্টা; বাবুল মেরাজ। মুসলিম শরীফ; ১ম খণ্ড ৯১ পৃষ্টা বাবুল ইসরা। আবু আওয়ানা; ১ম খণ্ড ১২১ পৃষ্টা)
ইমাম জুরকানী (রহঃ) লিখেছেন যে, মেরাজের ঘটনা ৪৫ জন ছাহাবী থেকে বর্ণিত আছে। (জুরকানী শরহে মাওয়াহিবুল্লাদুন্নী; ১ম খণ্ড ৩৫৫ পৃষ্টা)
আরোও উল্লেখ্য যে, মে’রাজ সম্পর্কিত হাদিছ বিভিন্নভাবে কমপক্ষে ৪৫জন ছাহাবা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে। বিশেষভাবে হাদিছের প্রথম দর্জার গ্রন্থ বুখারী, মুসলিম এবং অন্যান্য গ্রন্থে মওজুদ আছে। বিস্তারিত জানার জন্য পড়তে পারেন হজরত মাওলানা মুহাম্মদ সারফারাজ খান ছফদর (রহঃ) লিখিত গ্রন্থ “জাওউল সিরাজ ফি তাহকিকিল মে’রাজ”।
৩. সপ্তম আকাশ থেকে “লা-মাকাম” পর্যন্ত এই সফরকে বলা হয়- “এ’রাজ”। জ্ঞাতব্য যে, এই তিন সফরে হজরত জিব্রাইল (আঃ) সার্বক্ষনিকভাবে হজরত নবীয়ে করিম (সাঃ) এর সাথে ছিলেন; এমনকি লা- মাকান পর্যন্ত তাঁর সাথে ছিলেন। অনেকে অজ্ঞতাবশতঃ ধারণা করে থাকেন যে, হজরত জিব্রাইল (আঃ) “সিদরাতুল মুন্তাহা” তে পৃথক হয়ে গেছেন এবং তারা ফার্সী কবিতা পাঠ করে থাকেন। যেমন-
اگر یک سرِ موئے برتر پرم
فروغ تجلّی بسوزو پرم
অর্থঃ যদি আমি এখান থেকে (সিদরাতুল মুন্তাহা) উপরে যায়, তাহলে আমার ৬ শত ডানা-পাখা পুঁড়ে ছাই যাবে” (ইরফান বখশিশ; শরহে হাদায়েক বখশিশ, ৪০৮ পৃষ্ঠ)। প্রিয় পাঠক, এই ধরণের কথার কোন ভিত্তি নেই; বরং বোখারী শরীফের ২য় খণ্ডে আছে-
فَعَلاَ بِهِ إِلَى الجَبَّار
ফাআলা’ বিহি ইলাল জাব্বার। অর্থঃ হজরত জিব্রাঈল (আঃ), হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) সঙ্গে নিয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামিন পর্যন্ত গেছেন। এছাড়া একথা বলা আদৌ সঠিক নয় যে, ফেরেস্তাগণ আগে যেতে পারবে না। বরং ফেরেস্তাগণ আল্লাহর আরশের চতুর্পাশ্বে হালকা বেঁধে আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করেন।
وَتَرَى الْمَلَائِكَةَ حَافِّينَ مِنْ حَوْلِ الْعَرْشِ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ ۖ وَقُضِيَ بَيْنَهُم بِالْحَقِّ وَقِيلَ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
(সূরাঃ জুমার; ৭৫)
কাজেই আলেমগণের এমন ধরণের ভিত্তিহীন আলোচনা না করাই উচিত নয়।
অতঃপর হজরত রাসূলে কারীম (সাঃ) বলেন-
রওয়াতু সুজুফা সুবহাতি ওয়াজহিহী।” আমি আল্লাহ রব্বুল আলামিনকে পর্দার আকৃতিতে দেখেছি এবং আমার ঠোঁঠ বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং সিজদায় পড়ে যায়, তখন আল্লাহ বললেন-
মা জি’তানী ইয়া হাবিবী?
তখন তিনি (সাঃ) বলেন- “আত্তাহিয়াতু লিল্লাহি, ওয়াস সালাওয়াতু, ওয়াত তায়্যিবা” অর্থাৎ কওলী (মৌখিক); ফে’লী (দৈহিক) ও মালি (আর্থিক) এবাদত নিয়েছি। এর উত্তরে আল্লাহতায়া’লা মৌখিক এবাদতের জন্য বললেন-
আস সালামু আলায়কা আয়্যুহান নাবী, ফে’লী এবাদতের জওয়াবে বলেন ওয়া রহমাতুল্লাহি; এবং মালী এবাদতের জন্য বলেন- ওয়া বারাকাতুহু অর্থাৎ আপনার মালে (সম্পদে) বর্কত হোক।
তখন আমাদের নবীজী বলেন- আস সালামু আলায়না ওয়া আলা এবাদিল্লাহিস সালিহীন। অর্থাৎ হে আল্লাহ এই সৌভাগ্য যেমনভাবে আমি পেলাম আপনার নেক বান্দাদেরও নছিব হোক।
একথা শুনে সাত আসমানের ফেরেস্তারা বলে উঠলঃ আশহাদু আন লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু। ফলে দুনিয়ার মানুষকে হুকুম দেয়া হলো তোমরা পড়-
আল্লাহুমা ছাল্লি আলা মুহাম্মদ (দরুদ শরীফ) এবং দোওয়া প্রার্থনা করো অর্থাৎ দোওয়া- এ মাছুরা।
শায়েখে আকবর মহিউদ্দীন ইবনুল আরাবী বলেন- “রাসূল (সাঃ) এর ৩৪ বার মেরাজ হয়েছে। ৩৩ বার রুহানী যা নবুওয়াতের ঘোষণার পূর্বে এবং ১ বার স্বশরীরে যা নবুওয়াতের ঘোষণার পরে।” মোদ্দা কথা, উম্মাতে মুহাম্মদীর সমস্ত আলেম একমত যে, হজরত নবীয়ে করিম (সাঃ) এর মে’রাজ জাগ্রত অবস্থায় এবং স্ব-শরীরে হয়েছিল; ঘুমন্ত অবস্থায় নয়। নবুওয়াতের ১১ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর হিজরতের ২ বছর আগে মেরাজ হয়েছিল এবং এটাই ছহি মত।
জ্ঞাতব্য যে, ছহীহ মত হলো- রাসূলের মে'রাজ রবিউল আউয়াল মাসের ১৭ তারিখে সংঘটিত হয়েছিল এবং সেই দিনটি সোমবার। অবশিষ্ট তারিখগুলোর কোন ভিত্তি নেই।
মে’রাজের রাতে ১৮ বছর সময় লেগেছিল; ২৭ বছর নয়। বলা হয়েছে একজন কলু বা তেলীর কাছে মে’রাজের রাতের হাকিকাত বা রহস্য প্রকাশিত হয়েছিল। সে বলছিল যে, সরিষা শেষ হয়ে যাচ্ছে , বলদ বা ষাড় একাধিক বার ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে; অথচ সকাল হচ্ছে না, ঘটনা কি(?)। (আল্লাহু আকবার)
রেফারেন্সেসঃ
______________________________________________
১. বোখারী শরীফ; হাদিছ নম্বর- ৩২০৭
২. ছহী মুসলিম; হাদিছ নম্বর- ৪১৫
৩. তাফসীরে কাসসাফ; ৫৮৯ পৃষ্টা
৪. তাফসীরে মুদারেক; ২য় খণ্ড, ৩৯১ পৃষ্টা।
৫. তাফসীরে বাহরুল উলুম (ফকিহ আবু লাইছ সমরকান্দী); ২য় খণ্ড, পৃষ্টা- ২৫৮
৬. বোখারী শরীফ; কিতাবুত তাওহিদ-৭৫৭০
৭. বুখারী শরীফ; ৩২০৬
৮. শেফা; কাজী আয়াজ, ৮৬ পৃষ্টা।
৯. জুরকানী শরহে মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া; ১ম খণ্ড- ৩৫৫ পৃষ্টা।
১০. কাশফুজ জুনুন; ১ম খণ্ড ৪৫৪ পৃষ্ঠা।
১১. আরো নির্ভরযোগ্য অন্যান্য গ্রন্থসমূহ।
Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url